সাম্প্রতিক সময়ে ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে এক অভিনব উদ্ভাবন। মূলত ব্লকচেইন হলো তথ্য সংরক্ষণের নিরাপদ ও উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়।
পৃথিবীর অর্থ ব্যবস্থার মূলে আছে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস। ‘ক’ যদি দাবী করে সে ‘খ’ কে দশ মুদ্রা পরিশোধ করেছে তবে এই ঘটনার অন্তত একজন সাক্ষী লাগবে যে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করবে এবং একজন কর্তৃপক্ষ লাগবে যে নিশ্চিত করবে যে ঐ দশ মুদ্রার বাজার মূল্য আসলেই দশ মুদ্রার সমান। বেশ বিড়ম্বনা! আবার ‘ক’ যদি দাবী করে যে সে পঞ্চাশ মুদ্রার মালিক তাকে কি আসলেই আমরা পঞ্চাশ মুদ্রার মালিক হিসাবে ধরে নেব? সেটাও নির্ধারণ করবে আসলে একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ।
এবার ধরা যাক দেশে মোট মুদ্রার পরিমাণ এক লক্ষ। তাহলে এর পঞ্চাশটির মালিক হচ্ছে ‘ক’। এখন কতৃপক্ষ যদি আরও দশ হাজার মুদ্রা ছাপানোর ব্যবস্থা করে তবে তো একটি মুদ্রার মূল্য আর এক থাকছে না, কিছুটা হলেও কমে যাচ্ছে। তাহলে ‘ক’ যে দাবী করলো সে পঞ্চাশ মুদ্রার মালিক, সেই দাবী তো সঠিক নয়! তাহলে ‘ক’ কি সেই মুদ্রার প্রকৃত মালিক? ‘ক’ এর মালিকানায় থাকা অবস্থাতেই যদি তার মুদ্রার মান কমে যায় তবে তো সে আসলে এর প্রকৃত মালিক নয়! ব্যাপক বিড়ম্বনা।
এই বিড়ম্বনার সমাধান নিয়ে বাজারে আবির্ভাব ঘটে সাংকেতিক মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেন্সি)। এই মুদ্রা বেশ কয়েকটি প্রাচীন সমস্যার সমাধান করে ফেলে। যেমন মালিকানা জনিত সমস্যা, কর্তৃপক্ষ জনিত সমস্যা, স্ফীতি ঘটিত সমস্যা ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তৈরি হয়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে সাংকেতিক মুদ্রা। এবং এই ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রথম মুদ্রাটির নাম বিটকয়েন।
ব্লকচেইনকে চিন্তা করা যায় একটা বিশাল একটা খাতার সাথে যেখানে একটা মুদ্রার জন্ম থেকে যাবতীয় লেনদেন এনক্রিপ্টেড অবস্থায় লেখা থাকে। এই খাতার বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে শুধু নতুন লেখা যোগ হবে কিন্তু কেউ কোনো লাইন মুছতে পারবে না। ব্লকচেইন নামক লেজার খাতায় এই লেনদেনগুলো একেকটা ব্লক আকারে যোগ করা হয়। প্রতিটা ব্লকের সাইজ (বাইট) নির্দিষ্ট। যেমন বিটকয়েনের ক্ষেত্রে একেকটা ব্লকের সাইজ প্রায় ১ মেগাবাইট। প্রতিটা ব্লকে তার আগের ব্লকের ইনফরমেশন থাকে। এভাবে ব্লকগুলি চেইনের মত করে যুক্ত থাকে বলেই এই লেজার খাতাটার নাম ব্লকচেইন। ব্লকচেইনের আরেকটি বিশেষত্ব থাকতে হবে, সেটা হচ্ছে এটি হবে ডিসেন্ট্রালাইজড। মানে একক কোন সার্ভার বা কম্পিউটার এটি সংরক্ষিত না থেকে বরং হাজার হাজার কম্পিউটারে এর একটি করে কার্বন কপি থাকবে। ফলে যদি কয়েকশ’ বা হাজার কম্পিউটার থেকে এটি হারিয়ে বা নষ্ট হয়েও যায় তবুও কোনো ক্ষতি হবে না, সবকিছু আগের মতই চলতে থাকবে। এই একই বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্লকচেইনে কেউ যদি দুইনম্বরি করতে চায় সেটাও একটা অসম্ভব ব্যাপারে। একটা ট্রাঞ্জেকশনে কিছু এদিক ওদিক করতে হলে তাকে ধরে ধরে প্রতিটা হোস্টের ব্লকচেইনের কপিতে গিয়ে পরিবর্তনটুকু করে আসতে হবে, যেটা এক কথায় অসম্ভব একটি কাজ। এই কারণে ব্লকচেইন অত্যন্ত নিরাপদ এবং এর অথেন্টিসিটি বা ইন্টিগ্রিটির উপর চোখ বন্ধ করে আস্থা রাখা যায়।
সাতোশি নাকামতো ছদ্মনামের এক ব্যক্তিকে ব্লকচেইন প্রযুক্তির উদ্ভাবক বলে মনে করা হয়। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো বিটকয়েন সফটওয়্যার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ব্লকচেইন প্রযুক্তির বিবর্তন ঘটে চলছে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে তথ্য আদান-প্রদানের অপরিবর্তনীয় ও নিরাপদ মাধ্যম ব্লকচেইন প্রযুক্তি চালু করা হচ্ছে। কারণ এ প্রযুক্তি একটি নিরাপদ মাধ্যম। এই পদ্ধতিতে আর্থিক লেনদেন ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, মেধাস্বত্ব, স্বাস্থ্যসেবা, মালিকানার তথ্য সংরক্ষণ ও আদান-প্রদান শুরু হয়েছে।
ব্লকচেইন একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন। যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো কাজ পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে। এটা এমন একটি বণ্টনযোগ্য ডাটাবেজ যাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোর মধ্যে সব লেনদেনের নথি করে রাখা যায়। প্রতিটি লেনদেন আবার সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা যাচাই করা হয়। একবার লেজারে কোনো তথ্য প্রবেশ করলে স্থায়ীভাবে তা থেকে যায় এবং কখনো মুছে ফেলা যায় না। ব্লকচেইন প্রতিটি একক লেনদেনের যাচাইযোগ্য রেকর্ড নিয়ে গঠিত হয়।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে স্মার্টফোন। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ও নিরাপদ এই স্মার্টফোনের নাম ‘ফিনি’। আগামী মাসে দেশের বাজারে ‘ফিনি’ উন্মুক্ত করতে পারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান- ইনডেক্স।
ব্লকচেইন ২.০ এর পর আমরা প্রবেশ করছি ব্লকচেইন ৩.০ এর জগতে। ব্লকচেইন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন মাইনিং এর জন্য বিপুল পরিমাণ কম্পিউটেশন, ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদি খরচ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু ইথেরিয়াম মাইনিং এর জন্য যে বিদ্যুৎ খরচ হয় সারা পৃথিবীতে তা দিয়ে সাইপ্রাস নামক দেশটির সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চাহিদা মিটানো সম্ভব। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে মাত্রাটা ভয়াবহ। বিটকয়েন মাইনিং এর পিছনে যে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে তা পৃথিবীর ছোটবড় প্রায় ১৫৯ টি দেশের এক বছরের বিদ্যুৎ খরচের সমান! এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধানের জন্য এখন গবেষণা চলছে তৃতীয় প্রজন্মের ব্লকচেইন নিয়ে। এর মধ্যে শুরুতেই যাদের নাম আসবে তারা হচ্ছে IOTA, Cardano, Universa ইত্যাদি।
অ্যান্ড্রয়েড ৮.১-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি সিরিন ওএস ভিত্তিক ফোনটিতে দুই ইঞ্চি স্লাইডার ‘সেফ স্ক্রিন’ রয়েছে। এতে ইন্ট্রুসন প্রোটেকশন সিস্টেম (আইপিএস) রয়েছে। এর বাইরে নিরাপদ যোগাযোগ, একাধিক কাজের সক্ষমতা, ক্রিপটোওয়ালেট এবং গুগল প্লে স্টোরের পাশাপাশি ডিসেন্ট্রালাইজ অ্যাপ্লিকেশন (ডিঅ্যাপ) সুবিধা থাকছে।
**রিলেটেড আর্টিকেল**